ঢাকা ১১:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সার্টিফিকেট যেন শুধু আলমিরাতে ঠাই না হয়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৩৮:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০১৬
  • ৪২৭ বার

প্রতিবছর দেশে অহরহ ‘এ’ প্লাস বের হয়, এস এস সি এবং এইচ এস সি পরীক্ষায়। এবং প্রতিবছরই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পাশের হার বেশি থাকে। পত্রপত্রিকা ছেয়ে যায় মেয়েদের পাশ করার উল্লাসের ছবি দিয়ে। ব্যাপারটি খুবই প্রসংশাজনক।

তবে যত সংখ্যক মেয়ে প্রতিবছর চমৎকার রেজাল্ট করে বের হয় তার মধ্যে কতো সংখ্যক মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় নাম লেখায়? অথবা কতো সংখ্যক মেয়েরা তাদের রেজাল্টের সঠিক ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়, চাকরি করে? প্রতি বছর যে হারে মেয়ে পরীক্ষার্থী পাশ করে তার অনুপাতে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম বলাই বাহুল্য। তাহলে কোথায় যায় এতো এতো এ প্লাস ধারি মেয়ে শিক্ষার্থী?

একটি সংখ্যা আছে যা অর্থের অভাবে বা পরিবারের ইচ্ছের জন্য পরবর্তী শিক্ষার স্তরে পা দিতে পারে না। এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্তই যাদের বিচরণ।

অপর একটি সংখ্যা আছে যা সকল স্তরে পা দেয়। এইচএসসি শেষ করে অনার্স মাস্টার্স পর্যন্তও যায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আমরা মেয়েদের উপস্থিতি দেখি ব্যাপক ভাবে। বেশ! তবে এতো এতো উচ্চ শিক্ষা নেওয়া মেয়েদের কেন চাকরির ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না? কেন যেকোনো অফিসে নারী কর্মচারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য?

এরা পাশ করে কোথাও যায় না, ঘুরেফিরে ঘরের মেয়ে ঘরেই ফিরে আসে। আমরা মেয়েদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই ঠিকই কিন্তু চাকরি করতে দিতে বহুবার চিন্তা করি। মেয়েরা ভাল ফলাফল করলে গর্বিত হই ঠিকই কিন্তু পাশের পর সবার আগে চিন্তা করি মেয়ের বিয়ের কথা, ভাল চাকরির কথা নয়।

পরিবার যখন মেয়ের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করে তখন খুব গর্ব করে প্রচার করে মেয়ে খুবই ভাল ছাত্রী, এই করেছে সেই করেছে। যেন ভাল ফলাফল ভাল পাত্র পাওয়ার অন্যতম উপায়। মেয়ে ভাল ফলাফল করে নি? ও আচ্ছা তাহলে মেয়ে ভাল পাত্রী নয়। বিয়ে সংসার পরিবার লালন পালনে এ’প্লাসের কী মূল্য সে আমার বোধগম্য নয়। শ্বশুর বাড়িতেও খুব ফলাও করে প্রচার করে বৌ তাদের এই পাশ সেই পাশ। কিন্তু কেউ বলে না এই পাশ দিয়ে সে কী করছে? এই পাশের সার্টিফিকেটগুলো তার আলমিরাতেই শোভা পায় , কোন প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা প্রদর্শনে নয়। ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে জীবনের সকল পরীক্ষায় যে মেয়েটি চমৎকার ফলাফল করেছে তার অবস্থান হয় রান্না ঘরে, চমৎকার রান্নাতেই তার যোগ্যতা জাহির হয়, পরিবারের সবাইকে কতটা সুখে রাখতে পেরেছে তার উপর নির্ভর করে তার মেধার পরিচয়।

যদি প্রশ্ন করা হয় কেন চাকরি করছেন না, বা করতে দিচ্ছেন না তবে একটি কমন উত্তর পাওয়া যায় পরিবারের কাছ থেকে। “বিয়ে হোক, তারপর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ি যদি দেয় তবে চাকরি করবে”

একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে জীবনে চাকরি করবে কি করবে না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই। জীবনে সকল কঠিন প্রশ্নের উত্তর লিখে যে মেধাতালিকায় নাম লেখায় তার স্বাবলম্বী হওয়া নির্ভর করে স্বামীর উপর , শ্বশুর বাড়ির উপর! অর্থাৎ মেয়ে তুমি যত ডিগ্রী অর্জন করো না কেন দিন শেষে তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিবে অন্যরা। তোমার ডিগ্রী, ভাল ফলাফল তোমাকে স্বাধীন করতে পারে নি।

পাশের হার বাড়ছে কিন্তু নারী মুক্তি কি ঘটছে? এই পাশ যদি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হত তবে আজ স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যা পাশ করা নারীর সমানুপাতিক হত। কিন্তু আমাদের মানসিকতা সেই আদিকালের ‘বিয়েই নারীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ’ চিন্তায় আটকে আছে। মেয়েদের পড়াশুনা করা উচিত বলে তাদের জন্য আমরা স্কুল কলেজ বানিয়েছি, তাদের শিক্ষা দিচ্ছি, কিন্তু স্বাবলম্বী হতে কি দিচ্ছি? নারীরা এগিয়ে যাবে পুরুষদের পাশাপাশি এই চিন্তা থেকে যদি মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুকূল করা হত তবে চাকরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানতে এতো বাধা কেন? মেয়েরা এগিয়ে যাবে মানে এই নয় যে তারা পরীক্ষায় শুধু এ প্লাস পেয়েই থেমে থাকবে। মেয়েরা এগিয়ে যাবে মানে হচ্ছে শিক্ষা শেষ করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে, নিজের যোগ্যতা আর ডিগ্রীগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য একটি শক্ত অবস্থা গড়ে তুলবে ; ঠিক সেইভাবে যেভাবে একজন ছেলে করে। ছেলে এ’প্লাস পাক আর এ’মাইনাস পাক, তাঁকে জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে কাজ করতে হয়। পরিবার সমাজ তাকে শেখায় যে সবার আগে স্বাবলম্বী হওয়া , এরপরে ঘর সংসার বিয়ে করা। এবং আদিকাল থেকে সে নিয়ম নারীর জন্য বহাল ‘আগে ঘর সংসার বিয়ে, পরে অন্য কিছু’ সেই নিয়ম এখনও বর্তমান বাঙালি সমাজে বহাল। পার্থক্য শুধু এই, আগে মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, এখন আছে।আগে রূপ রঙ বয়স ঘরের কাজ সেলাই বুনন কে কতটুকু পারে এই হতো ভাল পাত্রীর যোগ্যতা। এখন ভাল পাত্রীর যোগ্যতা হচ্ছে কার কতো উচ্চতর ডিগ্রী আছে। কিন্তু লক্ষ্য সেই আগেরটাই রয়ে গেছে। সমাজ কিন্তু শেখায় না যে “নারী তোমার লক্ষ্য হবে আগে স্বাবলম্বী হওয়া পরে ঘর সংসার বিয়ে”

প্রতিটি ভাল ফলাফলের পিছনে কী কঠিন অধ্যবসায় আর শ্রম দিতে হয় তা একজন ছাত্র ছাত্রী খুব ভাল করেই জানে। রান্নায় তেল নুন মরিচের হিসেব করতে এই ফলাফলের কোন প্রয়োজন

নেই, স্বামী সন্তানদের দেখাশুনা করার জন্য এই ফলাফলের কোন দরকার নেই। এই ফলাফল দরকার নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার জন্য। প্রতিটি সার্টিফিকেটের অবস্থান হওয়া উচিত কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা পরিমাপের জন্য , আলমিরাতে জামা কাপড়ের মাঝে অবহেলায় পড়ে থাকার জন্য নয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সার্টিফিকেট যেন শুধু আলমিরাতে ঠাই না হয়

আপডেট টাইম : ১১:৩৮:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০১৬

প্রতিবছর দেশে অহরহ ‘এ’ প্লাস বের হয়, এস এস সি এবং এইচ এস সি পরীক্ষায়। এবং প্রতিবছরই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পাশের হার বেশি থাকে। পত্রপত্রিকা ছেয়ে যায় মেয়েদের পাশ করার উল্লাসের ছবি দিয়ে। ব্যাপারটি খুবই প্রসংশাজনক।

তবে যত সংখ্যক মেয়ে প্রতিবছর চমৎকার রেজাল্ট করে বের হয় তার মধ্যে কতো সংখ্যক মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় নাম লেখায়? অথবা কতো সংখ্যক মেয়েরা তাদের রেজাল্টের সঠিক ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়, চাকরি করে? প্রতি বছর যে হারে মেয়ে পরীক্ষার্থী পাশ করে তার অনুপাতে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম বলাই বাহুল্য। তাহলে কোথায় যায় এতো এতো এ প্লাস ধারি মেয়ে শিক্ষার্থী?

একটি সংখ্যা আছে যা অর্থের অভাবে বা পরিবারের ইচ্ছের জন্য পরবর্তী শিক্ষার স্তরে পা দিতে পারে না। এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্তই যাদের বিচরণ।

অপর একটি সংখ্যা আছে যা সকল স্তরে পা দেয়। এইচএসসি শেষ করে অনার্স মাস্টার্স পর্যন্তও যায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আমরা মেয়েদের উপস্থিতি দেখি ব্যাপক ভাবে। বেশ! তবে এতো এতো উচ্চ শিক্ষা নেওয়া মেয়েদের কেন চাকরির ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না? কেন যেকোনো অফিসে নারী কর্মচারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য?

এরা পাশ করে কোথাও যায় না, ঘুরেফিরে ঘরের মেয়ে ঘরেই ফিরে আসে। আমরা মেয়েদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই ঠিকই কিন্তু চাকরি করতে দিতে বহুবার চিন্তা করি। মেয়েরা ভাল ফলাফল করলে গর্বিত হই ঠিকই কিন্তু পাশের পর সবার আগে চিন্তা করি মেয়ের বিয়ের কথা, ভাল চাকরির কথা নয়।

পরিবার যখন মেয়ের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করে তখন খুব গর্ব করে প্রচার করে মেয়ে খুবই ভাল ছাত্রী, এই করেছে সেই করেছে। যেন ভাল ফলাফল ভাল পাত্র পাওয়ার অন্যতম উপায়। মেয়ে ভাল ফলাফল করে নি? ও আচ্ছা তাহলে মেয়ে ভাল পাত্রী নয়। বিয়ে সংসার পরিবার লালন পালনে এ’প্লাসের কী মূল্য সে আমার বোধগম্য নয়। শ্বশুর বাড়িতেও খুব ফলাও করে প্রচার করে বৌ তাদের এই পাশ সেই পাশ। কিন্তু কেউ বলে না এই পাশ দিয়ে সে কী করছে? এই পাশের সার্টিফিকেটগুলো তার আলমিরাতেই শোভা পায় , কোন প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা প্রদর্শনে নয়। ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে জীবনের সকল পরীক্ষায় যে মেয়েটি চমৎকার ফলাফল করেছে তার অবস্থান হয় রান্না ঘরে, চমৎকার রান্নাতেই তার যোগ্যতা জাহির হয়, পরিবারের সবাইকে কতটা সুখে রাখতে পেরেছে তার উপর নির্ভর করে তার মেধার পরিচয়।

যদি প্রশ্ন করা হয় কেন চাকরি করছেন না, বা করতে দিচ্ছেন না তবে একটি কমন উত্তর পাওয়া যায় পরিবারের কাছ থেকে। “বিয়ে হোক, তারপর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ি যদি দেয় তবে চাকরি করবে”

একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে জীবনে চাকরি করবে কি করবে না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই। জীবনে সকল কঠিন প্রশ্নের উত্তর লিখে যে মেধাতালিকায় নাম লেখায় তার স্বাবলম্বী হওয়া নির্ভর করে স্বামীর উপর , শ্বশুর বাড়ির উপর! অর্থাৎ মেয়ে তুমি যত ডিগ্রী অর্জন করো না কেন দিন শেষে তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিবে অন্যরা। তোমার ডিগ্রী, ভাল ফলাফল তোমাকে স্বাধীন করতে পারে নি।

পাশের হার বাড়ছে কিন্তু নারী মুক্তি কি ঘটছে? এই পাশ যদি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হত তবে আজ স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যা পাশ করা নারীর সমানুপাতিক হত। কিন্তু আমাদের মানসিকতা সেই আদিকালের ‘বিয়েই নারীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ’ চিন্তায় আটকে আছে। মেয়েদের পড়াশুনা করা উচিত বলে তাদের জন্য আমরা স্কুল কলেজ বানিয়েছি, তাদের শিক্ষা দিচ্ছি, কিন্তু স্বাবলম্বী হতে কি দিচ্ছি? নারীরা এগিয়ে যাবে পুরুষদের পাশাপাশি এই চিন্তা থেকে যদি মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুকূল করা হত তবে চাকরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানতে এতো বাধা কেন? মেয়েরা এগিয়ে যাবে মানে এই নয় যে তারা পরীক্ষায় শুধু এ প্লাস পেয়েই থেমে থাকবে। মেয়েরা এগিয়ে যাবে মানে হচ্ছে শিক্ষা শেষ করে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে, নিজের যোগ্যতা আর ডিগ্রীগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য একটি শক্ত অবস্থা গড়ে তুলবে ; ঠিক সেইভাবে যেভাবে একজন ছেলে করে। ছেলে এ’প্লাস পাক আর এ’মাইনাস পাক, তাঁকে জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে কাজ করতে হয়। পরিবার সমাজ তাকে শেখায় যে সবার আগে স্বাবলম্বী হওয়া , এরপরে ঘর সংসার বিয়ে করা। এবং আদিকাল থেকে সে নিয়ম নারীর জন্য বহাল ‘আগে ঘর সংসার বিয়ে, পরে অন্য কিছু’ সেই নিয়ম এখনও বর্তমান বাঙালি সমাজে বহাল। পার্থক্য শুধু এই, আগে মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, এখন আছে।আগে রূপ রঙ বয়স ঘরের কাজ সেলাই বুনন কে কতটুকু পারে এই হতো ভাল পাত্রীর যোগ্যতা। এখন ভাল পাত্রীর যোগ্যতা হচ্ছে কার কতো উচ্চতর ডিগ্রী আছে। কিন্তু লক্ষ্য সেই আগেরটাই রয়ে গেছে। সমাজ কিন্তু শেখায় না যে “নারী তোমার লক্ষ্য হবে আগে স্বাবলম্বী হওয়া পরে ঘর সংসার বিয়ে”

প্রতিটি ভাল ফলাফলের পিছনে কী কঠিন অধ্যবসায় আর শ্রম দিতে হয় তা একজন ছাত্র ছাত্রী খুব ভাল করেই জানে। রান্নায় তেল নুন মরিচের হিসেব করতে এই ফলাফলের কোন প্রয়োজন

নেই, স্বামী সন্তানদের দেখাশুনা করার জন্য এই ফলাফলের কোন দরকার নেই। এই ফলাফল দরকার নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার জন্য। প্রতিটি সার্টিফিকেটের অবস্থান হওয়া উচিত কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা পরিমাপের জন্য , আলমিরাতে জামা কাপড়ের মাঝে অবহেলায় পড়ে থাকার জন্য নয়।